* দুই উপদেষ্টাকে সেপ্টেম্বরেই পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল
* উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ‘বিতর্কিত’ ও ‘দলীয়দের’ বাদ দিতে চাপ দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত
* প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এনসিপি
* প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি: রাশেদ খান
গুঞ্জন উঠেছে,অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বড় ধরনের পরিবর্তনের। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ‘বিতর্কিত’ ও ‘দলীয়দের’ বাদ দিতে সম্প্রতি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিরও চাপ রয়েছে। তবে প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। এমন পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সসম্মানে পদত্যাগের কথাও ভাবছেন। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী সরকার পতনের পর প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর পর বেশ কয়েকবার সংযোজন-বিয়োজনে পরিবর্তন আনা হয় সরকারে। কয়েক দফা নিয়োগের পর বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন।
সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টাকে সম্প্রতি একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনাসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ বিষয়ে উপদেষ্টার একান্ত সচিবের (পিএস) কাছে দিনক্ষণ ও সম্মতি চাওয়া হলে নাকচ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘স্যার বলেছেন, এখন যাওয়ার সময় হয়েছে, এসব বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলোর দিকে মনোযোগ দাও। আমরা আছিই বা কদিন! যেকোনো দিন চলে যেতে হবে! প্রায় অভিন্ন ঘটনা ঘটেছে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের এক উপদেষ্টার দপ্তরেও। শুধু এই দুই উপদেষ্টার ক্ষেত্রে নয়, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তরে অনিষ্পন্ন সংস্কার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ‘তাড়া’ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদ নতুন করে গঠন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে এ বিষয়ে চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রটি আরও জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার থাকা দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আরো সময় নিতে চেয়েছেন। এই দুই উপদেষ্টা হলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শুধু তাই নয়, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি সরকারে থাকতে চান। তবে আসিফ মাহমুদ গত ১৪ আগস্ট সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তিনি পদত্যাগ করবেন। অন্যদিকে মাহফুজ আলম গত ২৮ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছিÑ আমি কখন নেমে যাই। মানে আমি কখন নামব, আমি জানি না। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বৈঠকের পর এই গুঞ্জন আরো তীব্র হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সচিবালয়ের কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রশাসনিক কাজে এক ধরনের ‘তাড়াহুড়া’ লক্ষ করা গেছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো উপদেষ্টা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করে একাধিক উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) প্রায় অভিন্ন ভাষায় জানান, ভাই! উপদেষ্টা স্যাররা আর কদিনই বা আছেন? আমাদের এখন যাওয়ার সময় হয়েছে। যেকোনো সময় আমাদের চাকরি নট হয়ে যাবে। একদিন হয়তো ঘুম থেকে উঠে শুনব স্যার নেই! স্যার পদত্যাগ করলে আমাদেরও দায়িত্ব নেই। হয়তো অন্য কোথাও পদায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দোয়া করবেন ভাই। এর আগে ২১ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল।
ওই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সরকারে কোনো দলীয় ব্যক্তি থাকলে তাদের অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। সেক্রেটারিয়েটে যারা এখনো আছেন, যাদের চিহ্নিত ফ্যাসিস্টের দোসর বলা হয়, তাদের সরিয়ে সেখানে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা দেওয়ার জন্য আমরা বলেছি। ওই বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিতর্কিত কোনো কর্মকর্তা, বিশেষ করে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ শাসনামলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কর্মকর্তাদের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন থেকে নিবৃত রাখতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহবান জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। নির্বাচনের আগে প্রশাসনে রদবদলে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতেও প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে। এই বৈঠকে তারা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বৈঠকের পর জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসনে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অফিসারই একটি দলের আনুগত্য করছে। আমরা গেলে তারা বলে প্রচণ্ড চাপ। এই যে চাপ, এই চাপ একটি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। আমরা সরকারকে বলেছি নির্বাচনের আগে যেখানে যেখানে রদবদল করা প্রয়োজন, সেটি করুন।
একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রশাসন ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে অভিযোগ করে নাহিদ বলেন, জনপ্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। এমনকি উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও এ ব্যাপারে সহায়তা করা হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলীয়করণের অভিযোগ আছে, প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এর পর বক্তব্য দিয়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। গত ২১ অক্টোবর এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, স্বজনপ্রীতিবাজ এসব উপদেষ্টা কতটুকু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারবেন, সেটি নিয়ে এখন দেশজুড়ে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের রদবদল নয়, উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যেও শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি। যেসব উপদেষ্টা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের সরিয়ে দিয়ে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা উচিত। জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদে অবিলম্বে পরিবর্তন আনা ছাড়া বিকল্প নেই। এমন পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সসম্মানে পদত্যাগের কথাও ভাবছেন। এ জন্য তাদের মন্ত্রণালয়ে এক ধরনের প্রস্তুতি চলছে বলে একটি সূত্র আভাস দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কয়েক দফা নিয়োগের পর বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন। তাদের মধ্যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে সম্প্রতি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তিন রাজনৈতিক দল। এ ছাড়া অন্যান্য দলের পক্ষ থেকেও এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া কয়েকটি দলও এমন প্রশ্ন তুলে সরকারকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের তাগিদ দেয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন
বড় পরিবর্তনের আভাস অন্তর্বর্তী সরকারে
- আপলোড সময় : ২৪-১০-২০২৫ ১১:১৯:৫২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-১০-২০২৫ ১১:১৯:৫২ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার